রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:০৩ অপরাহ্ন
গজারিয়া প্রতিনিধি : মুন্সীগঞ্জ গজারিয়া উপজেলার ইসমানিরচর গ্রামের মৃত আহসান উদ্দিনের ছেলে সেলিম বেপারী। বয়স ৪২ বছর। মেঘনা নদীর তীরে ১৪ শতাংশ জায়গা ছিল। ইতিমধ্যে ৯ শতাংশ জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। মাত্র ৫ শতাংশ জায়গা আছে। সেটাও নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। উত্তাল মেঘনা তার সর্বস্ব শেষ করে দিচ্ছে। প্রতিবছর ঘর বাঁধে ঘর ভাঙ্গে। নিজ উদ্যোগে বাঁশ দিয়ে বাঁধ দেয়। বাঁধ ভাঙ্গে। এখনও ভাঙছে। সর্বস্ব হারিয়ে আজ নিঃস্ব।
সেলিম বেপারী জানান, তার দাদা আর্শেদ মুন্সীর এক বিঘা জমি ছিল। তার সবই কেড়ে নিয়েছে ভয়াল মেঘনা নদী। পৈত্রিক ভিটায় বসবাস করছি। প্রতিবছর ২০ হাজার টাকা খরচ করে বাঁধ দেই। নদীর ভাঙ্গনে তা বিলীন হয়ে যায়। বর্তমানে ভাঙ্গাগড়ার মধ্যেই জীবন যাপন করছি। নদীর তীরে-ভাঙনের সাথে প্রতিদিনই যুদ্ধ করছি।
নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত আমির হোসেন প্রধান। ৭০ বছর বয়স। তিনি জানান, তাদের প্রায় ২০ শতাংশ জায়গা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বর্ষা মৌসুমে নদীর পানি বৃদ্ধি, মেঘনার উত্তাল ঢেউ আর ড্রেজার দিয়ে নদী তীরবর্তী অঞ্চলে বালু উত্তোলনে ফলে আমাদের বছরের পর বছর আমাদের এই সর্বনাশ হচ্ছে। দেখার কেউ নেই। সরকারি কোনো সহযোগিতা নেই। কিছু দিন আগে ইউএনও মেডাম ৩০ কেজি চাল দিয়েছে।
৫৫ বছর বয়সী আজিজুল হক জানান, মেঘনা নদীর তীরে আমাদের বসবাস। জন্মের পর থেকেই দেখে আসছি ভাঙ্গা গড়ার খেলা। প্রতিবছর ঘর এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরিয়ে নিতে হয়। অন্যত্র জায়গা না থাকায় এখানেই মানবেতর জীবনযাপন করছি।
ইসমাইল (৭০) নামের আরেক গ্রামবাসী জানালেন, সরকার এই জায়গায় কেন বালু খেকোদের ইজারা দেয়। বুঝি না। তীর ঘেঁষে বালু উত্তোলনের ফলে আমাদের বছরের পর বছর সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে। ৪ কানি জমি সব নিয়ে গেছে মেঘনা নদী। এখন ইসমানির চর নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। সরকারের উচিত নদী ভাঙন রোধে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা নেয়া দরকার।
বৃহস্পতিবার সরেজমিনে ভাঙনপ্রবন গজারিয়ার ইসমানির চর গ্রাম ঘুরে এসব লোকজনের সাথে কথা বলে এসব জানা যায়। সরেজমিনে দেখা যায়, ইসমানির চরের প্রায় দেড় কিলোমিটার এলাকা নদী ভাঙনের শিকার। এখানে প্রায় সাত শতাধিক পরিবারের বসবাস। দেড় শতাধিক রয়েছে জেলে পরিবার। সবাই মানবেতর জীবন যাপন করছে।
জানা গেছে, দীর্ঘ প্রায় অর্ধশত বছর ধরে মেঘনা নদী ভাঙনের এই নির্মম খেলা চলছে। ২০০০ সাল থেকে শুরু হয়েছে বালু উত্তোলনের ইজারা। নদী তীরবর্তী এ অঞ্চলে বালু উত্তোলনের ফলে ভাঙনের রূপ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।
বর্তমানে ইজারা বন্ধ হলেও অচিরেই আবার ইজারা দেয়া হচ্ছে বলে জানালেন গজারিয়া উপজেলার ইউএনও মাহবুবা বিলকিস। ফলে আবারও হুমকি মুখে পড়বে ইসমানির চরের শত শত পরিবার।
গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, মোল্লাবাড়ি, মুফতি বাড়ি, বেপারী বাড়ি, জেলে সম্প্রদায়ের প্রায় দেড়শ’ পরিবার, প্রধান বাড়ি, খান বাড়ি, জাহিদ বাড়ি, জমাদ্দার বাড়ি, সর্দার বাড়ি ও সরকার বাড়ির একাধিক পরিবার নদী ভাঙনের হুমকির মুখে বসবাস করছেন। জসিম উদ্দিন মুফতি, আব্দুল হাই মোল্লা, আহমদ মুফতি, বোরহান মুফতি, আওলাদ মুফতি, সেলিম বেপারী, আজিজুল হক বেপারী, দুলাল বেপারী, আজিজ খাঁন, সোহরাব প্রধান, ইসরাইল প্রধান, বোরহান মোল্লা, মোস্তফা মোল্লা, হান্নান, মনির হোসেন মোল্লা, ইদ্রিস আলী প্রধান, নাছির উদ্দিন সর্দার, মাহমুদ হোসেন সর্দার, মোজাফফর জাহিদ, শাহাবুদ্দিন জাহিদ, নাসির সর্দার ও চুন্নু সর্দারের বাড়িঘর নদী ভাঙনের শিকার হয়েছে। তারা পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। প্রতিনিয়ত ভাঙনের কবলে তাদের বাড়ি ঘর স্থানান্তর করতে হচ্ছে। নিজেদের দেয়া বাঁধ, বালুর বস্তা দিয়ে বাঁশ দিয়ে নির্মিত বাঁধ কিছুই মানছে না উত্তাল মেঘনা।
গ্রামবাসীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তাদের গ্রামের তীর ঘেঁষে বালু উত্তোলনের ফলে নদীর গভীরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রামের তলদেশে বালু সরে গেছে। এটাই ভাঙনের মূল কারণ। এদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়, মানব বন্ধন হয়। প্রতিবছর অবৈধ বালু উত্তোলনকারী ড্রেজার মালিক ও শ্রমিকদের সাথে সংঘর্ষে অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটছে। তবুও ইজারা দেয়া হয়। ইজারা দেয়া বন্ধ করতে হবে। এছাড়া প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে উত্তাল মেঘনার ঢেউ আরও ক্ষতি করছে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত এসব পরিবারকে রক্ষা করতে নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা দরকার। সরকারের সদিচ্ছা প্রয়োজন। গ্রামবাসীর দাবি বেরিবাঁধ নির্মাণ করে তাদের এ দীর্ঘদিনের সমস্যা সমাধান করা হোক।
১নং ওয়ার্ডের মেম্বার আব্দুল বাছেদ জাহিদ ও সাবেক মেম্বার আলী হোসেন জানান, দীর্ঘ বছর ধরে এখানকার ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। শত শত একর জমি আজ নদী গর্ভে বিলীন। বর্তমানে ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে আমরা যথাযথ কর্তৃপক্ষ হোসেন্দী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক মন্জু এবং গজারিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহবুবা বিলকিসকে অবহিত করা হয়েছে। তারা এলাকা পরিদর্শন করেছেন। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। আমরা নদী ভাঙনের স্থায়ী সমাধান চেয়েছি।
এ বিষয়ে গজারিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহবুবা বিলকিস জানান, সম্প্রতি আমরা নদী ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করেছি। ক্ষতিগ্রস্ত দেড়শ’ পরিবারের মাঝে পরিবার প্রতি ৩০ কেজি চাল বিতরণ করেছি। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়ে জেলা প্রশাসক বরাবরে চিঠি দিয়েছি। জেলা প্রশাসক ক্ষতিগ্রস্থ ২০ পরিবারকে নগদ ৫ হাজার টাকা করে মোট এক লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেয়ার বিষয়ে প্রকৌশলীর সাথে কথা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে চিঠি দেয়া হয়েছে। দেড় কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ভাঙন রয়েছে। বেরিবাঁধ দেওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সময় সাপেক্ষ ব্যাপার ও বিশাল অংকের অর্থের প্রয়োজন। আমরা এ লক্ষ্যে কাজ করছি। অর্থ বরাদ্ধ পেলে দীর্ঘ মেয়াদী ব্যবস্থা নেয়া হবে।